Monday, April 30, 2018

ফরিদপুর-চার যুদ্ধ হবে আর একবার

ফরিদপুর-চার
যুদ্ধ হবে আর একবার
***********************
প্রচলিত আছে যে ফরিদপুর-৪ আসনে আওয়ামী লীগের দাতা ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জাফর সাহেবের আসল বাড়ী কুমিল্লা। তিনি কিভাবে ফরিদপুরের নাগরিক ও ভোটার হলেন তা'ব্যাখ্যা নাই দিলাম। বলতে চাই বিগত সুদীর্ঘ একবার ৫ বছর এবং এবারে একটানা ৯ বছর ক্ষমতা থাকা সত্বেও কাজী জাফর উল্লাহ সাহেব ফরিদপুর-৪ আসনে এক ওড়া মাটিও কাটেন নি এবং এমন কোন নজির নেই যে তিনি গোটা আসনের কোথাও দুই টাকার উন্নয়ন করেছেন। এ কথা কারো মন গড়া গল্প নয়, এটা এলাকার সকল নৌকার ভোটারদের অভিযোগ। একটি বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে জাফর উল্লাহ সাহেব জনগণকে ক'দিন দিয়েছেন। হিসেব করলেই আসল পরিসংখ্যান বেড়িয়ে আসবে।
ফলে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ভক্ত অনুরাগী নৌকার ভোটার রা একজন জাফর উল্লাহ বিকল্প প্রার্থী সন্ধানে ছুটে বেড়ায় এবং প্রার্থনা করে; হঠাত কোথা থেকে উদয় হল নিক্সন চৌধূরী, গর্জে উঠলো ভাঙ্গা নগরকান্দার চির বঞ্চিত অবহেলিত মানুষগুলো। বিকল্প নেতা না পেয়ে বিকল্প মার্কাই বেছে নিতে হল সাধারণ ভোটারদের। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কন্যা নিজে সফর করে, মানুষকে প্রতিশ্রুতি এবং উদাত্ত আহবান জানিয়েও মানুষের মন এই খন্দকার মোস্তাক আহমেদের জেলায় জন্ম নেয়া কুমিল্লার জাফর উল্লাহর দিকে আকৃষ্ট করতে পারেন নি। যা'ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত নির্বাচনের সব চেয়ে ভরাডুবি এবং লজ্জাজনক।
মানুষের রুচিবোধ চিন্তা চেতনা ইচ্ছে আকাংখা আশা ভরসার প্রতিফলন যার মাঝে দেখতে পায়;তাকেই নির্বাচিত করে। দুরন্ত দুর্বার বঙ্গবন্ধুর নাতনি নিক্সনের মাঝে মানুষ তার কিছুটা হলেও খুজে পেয়েছে। সাথে যোগ দিয়েছিল স্বাধীনতা বিরোধীশক্তি জামাত বি এন পি। ফলে নৌকার কিছু ভোট এবং বি এন পি জামাতের ভোট নিক্সনের বাক্সে পরার ফলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ধনকুবের কিপটে জাফর উল্লাহ'র ভরাডুবি হয়।

বিষয় সেটি নয়; বিষয় হচ্ছে সব জেলায়/উপজেলার বঙ্গবন্ধু নৌকা পাগল মানুষগুলো কিছু না পেয়েই ভোট দেয় এ কথা সঠিক নয়" বলে প্রমান করেছিল ভাঙ্গা সদরপুরের মানুষ। তারা তাদের নিজস্ব এলাকার গরীব কৃষক শ্রমিক জেলে তাতী কামার কুমার ধনিক বনিকের পাশে উক্ত এলাকায় জন্ম নেয়া কোন একজনের প্রত্যাশায় ছিল। তারা পেয়ে গিয়েছে। নিক্সন চৌধূরী পদ্মা সেতু টেন্ডারবাজীতে কত শ্ত কোটি টাকা মেরেছে এবং সে টাকায় ফরিদপুর-৪ আসনের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। আমি এই "অর্থ লুন্ঠন এবং উন্নয়ন" দুটো শব্দকেই অভিনন্দন জানাই। টাকা চুরি করে যদি সে টাকা জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যয় করা হয়, তাহলে বলবো সকলেরই নিক্সন চৌধূরীর মত চোর হওয়া একান্ত অপরিহার্য ।
নিক্সনকে স্থানীয় মাস্তান দিয়ে হুমকি ধমকি দৌড়ানি পিটানি ভুয়া মামলা দিয়ে নেতা কর্মীদের হয়রানি ইত্যাদি করেও কাজী জাফর উল্লাহ সাহেব নিক্সন চৌধূরীর কিচ্ছু করত পারেন নি বরং নিক্সনের পিছনে টাকার জন্য নয়-উন্নয়ন এবং এই টগবগে যুবকের সাথে হাত মেলাতে মন প্রান খুলে নিজেদের সমস্যাদির কথা বলতে সারাক্ষন কাছে পায়; এটাই জনগণের সারা জীবনের চাহিদা ছিল-যেটা বয়োবৃদ্ধ ধনকুবের কিপটা অলস প্রেসিডিয়াম সদস্য জাফর উল্লাহ সাহেবের মধ্যে আদৌ তিল পরিমান পরিলক্ষিত হয়নি।
গত নির্বাচনে নিক্সন চৌধূরীর নিকট ভরাডুবির পর ইদানিং জাফর উল্লাহ সাহেব গ্রামে গ্রামে হাটে চেষ্টা করছেন, কিন্তু নিক্সন চৌধূরীর মত মন মানসিকতা ও দৈহিক স্ববলতার অভাবে নিক্সনের ১০ ভাগ অভিনয়েও তিনি ডাউব্বা মেরেছেন।
এখানে আওয়ামী লীগ বা নৌকার বিরোধীতার প্রশ্ন নয়; এখানে প্রশ্ন আমরা আর কত জাতিরজনকের নামে, মুক্তিযুদ্ধের নামে, স্বাধীনতার নামে নৌকা প্রতীকের নামে কাজী জাফর উল্লাহ সাহেবদের মত নবাবী মানদাতা আমলের পুরাতন কাসন্দ কাধে নিয়ে হাটবো?
শেখ হাসিনা তরুনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিশ্বাসী। আগামী প্রজন্ম মহান স্বাধীনতার ধারক ও বাহক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির পারিবারিক বন্ধনকে আরো শক্তিশালী করে আওয়ামী লীগের লাল সবুজের ৪ তারকা খচিত পতাকা তুলে দিচ্ছেন। তাঁর বয়স হয়েছে। একদিন তিনিও চলে যাবেন-জাফর উল্লাহ সাহেবদেরকেও যেতে হবে-সেদিন কে ধরবে হাল, কে তুলবে পাল? সূতরাং দেশরত্ন শেখ হাসিনার আদর সোহাগ ও স্নেহ ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা নিক্সন চৌধূরীদের ক্ষমতায়নে আমার পূর্ণ সমর্থন রইলো। অচল পয়সা দিয়ে কিছু ক্রয় বিক্রয় করা যায় না, তেমনি অচল নেতা দিয়ে জনগণের উন্নয়ন ও মন জয় করা যায়না। এ লজিক যদি ভ্রান্ত না হয়ে থাকে তাহলে আগামী নির্বাচনে আমরা ফরিদপুর ৪ আসনে কুমিল্লা থেকে ভেসে আসা কাজী জাফর উল্লাহ সাহেবের পরিবর্তে মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কৃতি সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মহান স্বাধীনতার অন্যতম সফল সংগঠক মরহুম ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী দাদাভাইয়ের পুত্র ও হুইপ লিটন চৌধুরীর ছোট ভাই জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর নাতি মোঃ মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধূরীকে আমরা ২০১৮ এর নির্বাচনে নৌকার মাঝি হিসেবে দেখতে চাই।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু
মুক্তিযোদ্ধা মোকতেল হোসেন মুক্তি


Sunday, April 29, 2018

বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে ভাষা সৈনিক আব্দুল গাফফার চৌধূরী

gaffar chyএজন্য প্রথমে তিনি আরবান মিডলক্লাস ও পেশাজীবীদের মধ্যে কলোনিয়াল যুগের শ্রেণী বৈষম্য বাকশাল ব্যবস্থায় ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। আমার পাঠকদের মধ্যে যারা প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আইনজীবীদের মধ্যে চারটি শ্রেণী ছিল। ব্যারিস্টার, এ্যাডভোকেট, প্লিডার এবং মোক্তার। এই পেশায় ব্যারিস্টার ও এ্যাডভোকেটরা ছিলেন অভিজাত, প্লিডার মধ্যম অভিজাত এবং মোক্তারেরা হরিজন শ্রেণী।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকতে তাঁর সম্পর্কে যত লেখা লিখেছি, তাঁর মৃত্যুর পর সেই লেখার সংখ্যা বহু গুণ বেশি। যতই লিখি ততই মনে হয়, তাঁর সম্পর্কে আরও আরও লেখার রয়ে গেছে। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিনই তাঁর সম্পর্কে লিখতে পারব। এতই বৈচিত্র্যপূর্ণ তাঁর জীবন। তিনি মহাদার্শনিক ছিলেন না, মহাপন্ডিতও ছিলেন না। কিন্তু মহাপন্ডিতরা বা মহাদার্শনিকরা যা করতে পারেননি, তিনি তা করেছিলেন। অর্থাৎ একটি লুপ্তপ্রায় জাতিকে তার ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব দান করেছেন এবং তার বিপন্ন সভ্যতা, সংস্কৃতি, ভাষা ও ইতিহাসকে রক্ষা করেছেন।
কথাটা বলেছিলেন, ব্রিটেনের প্রখ্যাত বাম দার্শনিক জ্যাক ওয়াডিস। তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্বে শোষণমুক্ত সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব প্রচার করেছেন কার্ল মার্কস। কিন্তু তিনি কোন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারেননি। সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন রাশিয়ায় আইনের ছাত্র লেনিন এবং চীনে স্কুল-শিক্ষক মাও জে দুং। তেমনিভাবে বলা চলে, স্বাধীন অথবা স্বতন্ত্র বাংলার স্বপ্ন সচেতন বা অবচেতনভাবে দেখেছেন অনেকেই; যেমন চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ বসু, ফজলুল হক, শরৎ বসু, আবুল হাশিম। তাঁরা কেউ বিখ্যাত ব্যারিস্টার ছিলেন, কেউ বিলেতে লেখাপড়া করা নেতা, কেউ বিখ্যাত আইনজীবী, কেউবা বিখ্যাত প-িত ও বাগ্মী ছিলেন। কিন্তু সচেতন বা অবচেতন মনের এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন কেউ করে যেতে পারেননি; করেছেন ফরিদপুরের টুঙ্গিপাড়ার একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শেখ মুজিবুর রহমান। তাই জাতির পিতার শিরোপাটি আজ তাঁকেই ধারণ করতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করে গেছেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা অনুযায়ী দেশটা গঠন করে যেতে পারেননি। তবে দেশ গঠনের সেই পথে পা বাড়িয়ে তিনি তাঁর স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার কাঠামোটা জাতিকে দান করে দিয়ে গেছেন। তাঁর নাম বাকশাল-দর্শন। বাংলাদেশে নব্যধনী এবং নব্য এলিট শ্রেণীর সমন্বয়ে পুরনো কায়েমি স্বার্থের (াবংঃবফ রহঃবৎবংঃ) উত্তরাধিকারী নব্য কায়েমি স্বার্থ গোষ্ঠী এই বাকশাল নাম শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। ড্রাকুলারা যেমন ক্রসচিহ্ন দেখলে ভয় পায়, বাংলাদেশের লুটেরা, সমাজপতিরা এই বাকশাল নাম শুনলে আঁৎকে ওঠে। কারণ এই বাকশাল-ব্যবস্থাটি ছিল পুরনো আমলাতান্ত্রিক শাসন এবং নব্যধনী গড়ে তোলার শ্রেণী শোষণমূলক ব্যবস্থা পরিবর্তনের একটি বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ সফল হলে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ এবং নব্যধনীদের সমন্বয়ে গঠিত গণশত্রু জোটের চক্রান্ত থেকে বাঁচতে পারত দেশটি। ১৯৭৫ সালের রক্তাক্ত ঘটনাগুলো আর কিছুই নয়, ছিল নিষ্ঠুর প্রতিবিপ্লব। তাতে শুধু জন প্রতিক্রিয়াশীলেরা নয়, বিভ্রান্ত এবং বিচ্যুত বামদের একটা বড় অংশও সাহায্য ও সমর্থন যুগিয়েছিল। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু মাত্র বাকশাল-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর বাস্তবতা ও সাফল্য দেখিয়ে যেতে পারেননি। ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের মাত্র আট মাসের মাথায়Ñঅর্থাৎ ব্যবস্থাটি যখন এক্সপেরিমেন্টের আঁতুড়ঘরে তখনই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয় এবং ব্যবস্থাটি উচ্ছেদ করা হয়। তারপর গত ৩৮ বছর ধরে চলেছে এই আট মাসের অপরীক্ষিত ব্যবস্থার ঢালাও নিন্দাবাদ। বাম এবং ডান উভয় রাজনীতির তরফ থেকে।
বিস্ময়ের কথা এই যে, বাকশাল-ব্যবস্থাকে ‘একদলীয় শাসন প্রবর্তন’ ‘গণতন্ত্র হত্যা’ ইত্যাদি বলে যখন অনবরত প্রচারণা চালানো হয়েছে, তখন আওয়ামী লীগের সামনের কাতারের নেতারা এবং আওয়ামী ঘরানার বলে পরিচিত অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শকে ডিফেন্ড করা বা অপপ্রচারের জবাব দেয়ার জন্য এগিয়ে আসেননি। বরং বাকশাল প্রসঙ্গ উঠলেও লজ্জাবতী লতার মতো গুটিয়ে গেছেন। যেন প্রসঙ্গটি এড়াতে পারলেই তাঁরা বাঁচেন। আদর্শের দ্বন্দ্বে আওয়ামী লীগ এখানে শত্রুপক্ষের কাছে হেরে গেছে।
আমার কাছে বিস্ময়কর, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কেবল শত্রুপক্ষই তাঁর নামনিশানা মুছে ফেলার জন্য তৎপর হয়েছিল তা নয়, আওয়ামী লীগরাও যারা ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক’ বলে এখনও বুক চাপড়ান, তাঁরা সর্বাগ্রে বঙ্গবন্ধুর শেষ জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য বাকশাল দর্শন ত্যাগ করেন, বাকশাল ভেঙ্গে দিয়ে আওয়ামী লীগ নামটিকে তার পাতি বুর্জোয়া চরিত্রসহ পুনরুজ্জীবিত করে তাতে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িক দল থেকে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দলে এবং গণতান্ত্রিক দল থেকে বাকশাল নামে সমাজবাদী দলে উত্তরণের যে ধারা অব্যাহত ছিল তা রুদ্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় শুধু আওয়ামী লীগের নয়, বাংলাদেশের গোটা ডান ও বাম রাজনীতির দ্রুত পশ্চাৎপসরণ। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে আবার শ্রেণী বিভক্ত সমাজব্যবস্থা এবং তাতে নবউত্থিত লুটেরা শ্রেণীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বর্তমানে আমার বাম বন্ধুরা যাদের ‘লুটেরা শাসন শ্রেণী’ বলে নিত্যগালি দেন, তাঁরা নিজেদের অজান্তেই নিজেরাও সেই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের বর্তমান ডান, বাম, মধ্যবাম, মধ্যডান সব রাজনীতির এবং রাজনীতিকদের উৎস একই সুবিধাবাদী ও লুটেরা নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তাঁদের কথাবার্তা, রাজনীতির খোলসে লাল, সবুজ, হলুদ, বাদামি নানা রঙ থাকতে পারে কারও লাঙ্গল, কারও চাঁদতারা প্রতীক থাকতে পারে, কিন্তু ভেতরে তাঁদের একই রঙ, একই শ্রেণীস্বার্থে তাঁরা বাঁধা। এ জন্যই আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি প্রভৃতি এখন বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক আদর্শের দল বলে পরিচিত। কিন্তু বাংলাদেশে এদের সকলের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা কেউ কৃষক শ্রমিক বা গরিব মানুষের প্রতিনিধি নন। তারা সকলেই নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেন। এরা মুখে বা সজ্ঞানে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মতন্ত্রের কথা বলেন, কিন্তু অবচেতনভাবে সামন্ত যুগীয় মনোভাব, পরিবারতন্ত্র এবং একই শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে চলেন। এ জন্যই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এত বিপুলসংখ্যক ফ্রন্ট থাকা সত্ত্বেও তা এতটা বিভক্ত এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার নামেও এরা ওই সাম্রাজ্যবাদেরই রক্ষিতার দায়িত্ব পালন করেন। আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজের বর্তমান ভূমিকা থেকে এই কথার সত্যতার আরও বেশি প্রমাণ মেলে।
বঙ্গবন্ধুর বাকশাল-দর্শন নিয়ে মুক্ত মনে কোন গবেষণা হলে দেখা যেত, তিনি মার্কসবাদী না হয়েও মার্কসের শ্রেণীদ্বন্দ্বে হয়ত বিশ্বাসী ছিলেন। আজকাল দেশ-বিদেশের অনেক নব্যপ-িত শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। তাঁরা বলেন, শ্রেণীসংগ্রামের যুগ শেষ হয়ে গেছে। কারণ, সমাজে শোষক ও শোষিত শ্রেণীর চরিত্র পাল্টে গেছে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, উন্নত ইউরোপেও শ্রেণীসংগ্রামের চেহারা পাল্টালেও মূল সংগ্রামটা শেষ হয়নি। ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের সরকারের আমলে কয়েক বছরব্যাপী খনি শ্রমিকদের ধর্মঘট এবং তা ভাঙ্গার জন্য গোটাব্রিটিশ এসটাবলিশমেন্ট, সেনা-পুলিশ বাহিনী, বিচার বিভাগ, শিল্পপতি, বড় ব্যবসায়ী এবং মিগমিডিয়ার সম্মিলিত চেষ্টার মধ্যে শ্রেণীসংগ্রামের ছবিটি বড় বেশি প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিল। রূপটি মারডোকের টাইমস পত্রিকার প্রিন্টিং ওয়ার্কার্সদের দীর্ঘ ধর্মঘটের মধ্যে শ্রেণীসংগ্রামের রূপটি আদৌ ঢাকা ছিল না। শ্রেণীসংগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। আধুনিক প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে একটি হোয়াইট কলার ওয়ার্কার্স শ্রেণীর উদ্ভব হওয়ায় এই সংগ্রামের চেহারা পাল্টে গেছে এবং গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম একটা সুবিধাজনক স্থানে আছে। যা হোক, এই তত্ত্ব নিয়ে আজ আলোচনা নয়।
বঙ্গবন্ধু হয়ত বাংলাদেশে শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও শ্রেণীসংগ্রাম এড়িয়ে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি এও ভেবে থাকতে পারেন, তিনি যখন দেশ স্বাধীন করে নিজে ক্ষমতায় বসতে পেরেছেন, তখন শ্রেণীসংগ্রাম এড়িয়ে নিজের ক্যারিশমা ও নেতৃত্ব গুণের জোরে বাংলাদেশে উদীয়মান লুটেরা একটি শ্রেণীর মাথা তোলা বন্ধ করে এতকালের শোষিত শ্রেণীরগুলোর অধিকার ও স্বার্থরক্ষা করতে পারবেন এবং রাষ্ট্রক্ষমতাতেও তাঁদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে পারবেন।
অনুরূপভাবে চিকিৎসকরা ছিলেন এমবিবিএস ও এলএমএফ এই প্রধান দুই ভাগে বিভক্ত। জার্নালিস্ট বা সাংবাদিক বলতে পত্রিকায় প্রুফ রিডারদের বোঝাতো না। তারা ছিল অন্ত্যজ শ্রেণী, সাংবাদিক ইউনিয়নে তাদের সদস্য হওয়ার অধিকার ছিল না। আরও অনেক পেশার ক্ষেত্রে সামন্তযুগীয় এই উঁচু-নিচুর অভিজাত ও অনভিজাত শ্রেণীভেদ আরবান নগর সমাজেও প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল।
বঙ্গবন্ধুর বাকশাল-প্রথায় এই শ্রেণীভেদ ও বৈষম্য লুপ্ত করা হয়। আইনজীবীদের চারটি শ্রেণী ভেঙ্গে শুধু এ্যাডভোকেট শ্রেণীতে সকলের পরিচয় সীমাবদ্ধ করা হয়। ব্যারিস্টারদেরও এ্যাডভোকেট হিসেবে পরিচিত হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মোক্তারদের শর্ট কোর্সের শিক্ষার মাধ্যমে এ্যাডভোকেট হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। মেডিক্যাল স্কুল থেকে যারা ডাক্তারী পাস করে এলএমএফ ডাক্তার নামে পরিচিত হতেন, তাঁদের এক বছরের শর্ট কোর্সে অধ্যয়ন দ্বারা এমবিবিএস হওয়ার অধিকার দেয়া হয়। এলএমএফ ডিগ্রী বাতিল করা হয়। সংবাদপত্রের প্রুফ বিডারদের সাংবাদিক হওয়ায় মর্যাদা দেয়া হয়। আরও অনেক পেশায় এই শ্রেণীভেদ ও বৈষম্য লুপ্ত করা হয়।
এটা ছিল আমাদের কায়েমী স্বার্থ ও অভিজাততন্ত্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় প্রচ- আঘাত। এই আঘাতের বৈপ্লবিক গুরুত্ব তখন আমরা অনেকেও অনুধাবন করতে পারিনি। আমার মনে আছে, একদিন প্রখ্যাত আইনজীবী মির্জা গোলাম হাফিজের বাসায় গেছি। দেখি, তিনি রাগে অন্ধ হয়ে বন্ধুবান্ধবের সামনে চিৎকার করছেন। বলছেন, শেখ সাহেব ভেবেছেন কি আমার মতো এক এ্যাডভোকেটকে তিনি একজন মোক্তারের সঙ্গে এক ঘাটে পানি খাওয়াবেন? এটা আমরা হতে দেব না।
তখনকার সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তাদের দাবি ছিল সংবাদপত্রের প্রুফ রিডারদের সাংবাদিক হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এই প্রতিনিধি দলে কতিপয় বামপন্থী সাংবাদিকও দেখেছি। তারা প্রুফ রিডারদের সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় সরকারের আইনের ঘোরবিরোধী। আগেই বলেছি, আমাদের ডান বাম সব রাজনীতির উৎস একই সুবিধাবাদী নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তাদের শ্রেণীস্বার্থে আঘাত পড়লে ডান বাম নির্বিশেষে সকলেই যে একই সুরে কথা বলতে পারেন, তার প্রমাণ তখন দেখেছি।
বঙ্গবন্ধু বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তন করতে গিয়ে ভীমরুলের চাকে খোঁচা দিয়েছিলেন। তাঁর পদ্ধতির বিরুদ্ধে শুধু সেনাতন্ত্র, আমলাতন্ত্র নয়, শ্রেণী বিভক্ত সমাজের সকল স্তরের শিরোমণিরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন বাকশাল প্রথা ও তাঁর প্রবর্তককে অবিলম্বে উৎখাতের জন্য। বাকশাল পদ্ধতি প্রবর্তন সফল হলে বাংলাদেশে একটি নীরব বিপ্লব ঘটে যেত। আজকের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, শোষণ ও লুণ্ঠনে জীর্ণ দেশটির চেহারা অন্য রকম হতো।
বাকশাল পদ্ধতিটি দেশে চালু হতে পারেনি। মাত্র আট মাস পদ্ধতিটি নিয়ে বঙ্গবন্ধু পরীক্ষা চালাবার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু এই আট মাসের (জানুয়ারি-আগস্ট, ৭৫) পরীক্ষা নিয়ে আটত্রিশ বছর যাবত প্রচারণা চালানো হচ্ছে, বাকশাল ছিল একদলীয় স্বৈরাচারী শাসন, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও ডিক্টেটরশিপ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। যাঁরা বুদ্ধিজীবী সেজে, সাংবাদিক ও কলামিস্ট সেজে এখনও এসব কথা প্রচার করেন, তাঁদের অধিকাংশই পরবর্তীকালে সামরিক শাসন থেকে শুরু করে গণবিরোধী সকল শাসনের গুণগান করেছেন। সেই শাসনের অনুগ্রহভোগী হয়েছেন।
তিন দশকেরও বেশি সময়ের কুৎসা, নিন্দা, চরিত্র হননের একটানা অভিযান ব্যর্থ করে বঙ্গবন্ধু আবার তাঁর উজ্জ্বল নন্দিত রূপটি নিয়ে জাতীয় মানসে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তিনি এখন নন্দিত। কিন্তু তাঁর বাকশাল-পদ্ধতিটি এখনও একশ্রেণীর মানুষের কাছে নিন্দিত। এক্ষেত্রে কুৎসা ও মিথ্যাচার সত্যকে ঢেকে রেখেছে। এই মিথ্যাকে পরাজিত করে সত্যের উদ্ঘাটন প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম নিয়ে এখন বহু বই পুস্তক বেরুচ্ছে, একই সঙ্গে দরকার বাকশাল পদ্ধতি নিয়ে সুষ্ঠু আলোচনা ও গবেষণা। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের স্বার্থেই বাংলাদেশের মুক্ত মনের গবেষক ও ইতিহাসবিদরা একদিন বাকশালের আসল চরিত্র ও লক্ষ্য খুঁজে বের করবেন এবং বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে এই বাকশালও একদিন নন্দিত হবে বিকৃতিমুক্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে।